রাত সাড়ে এগারটা, প্রায় নিস্তব্ধ ঢাকা, কল্যানপুর বাস কাউন্টারে উদ্বিগ্ন আমি, হাতে সিগারেট, পায়চারি করছি। রাতে আমার সিলেট যাবার কথা। সাথে আমার এক বন্ধু যাবে। শেষ বাস ছাড়বে রাত সোয়া বারটায়। আমার বন্ধুর মোবাইলে একের পর এক চেষ্টা করে যাচ্ছি। রিং হচ্ছে কিন্তু সে কল ধরছে না। মহা যন্ত্রণা। 'ভাই এইদিকে মোবাইল করা যায় কোনখানে?' - এই কথায় আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখি প্রায় ১০-১২ বছরের একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে প্যান্ট আর ছেড়া জামা। ভাই, এইখানে মোবাইলের দোকান নাই? রাত ৭ টায় দোকান বন্ধ। জানি। তাও বললাম, থাকার তো কথা, দেখ খোঁজ নিয়া। ছেলেটি চলে গেল।
রাত পৌনে বারটা, আমার বন্ধু এসে গেছে। টিকেট কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। কাউন্টারের একটু দূরে একটা রিক্সা-ভ্যান। তার পাশে একটা সিগারেটের দোকান। বললাম, চল ওইদিকে যাই। কাছে গিয়ে দেখি ভ্যানের ওপর ছেলেটি বসে আছে। সিগারেট নিয়ে আসার সময় জানতে চাইলাম মোবাইলের দোকান পেয়েছে কিনা। বলল, না। আমি বললাম, এত রাতে তো মোবাইলের দোকান পাওয়া যাবে না। সমস্যা নাই - ছেলেটির উত্তর। আমার বন্ধু বলল, বাসের আরো প্রায় আধাঘন্টা বাকি আছে, চল ভ্যানে বসি।
কথা বলতে বলতে কেন জানি ছেলেটিকে জিগ্গেস করলাম, এই ভ্যান কি তোমার। না। তাইলে এত রাইতে এইখানে বইসা আছো কেন? আমারে একজন নিতে আইবো। কখন? তারে একটা মোবাইল করলেই আমারে আইসা নিয়া যাইবো। আমি বললাম, মোবাইল তো করতে পারলা না, এখন কি করবা। বইসা থাকমু। কালকে সকালে মোবাইল করমু। আমার বন্ধুর প্রশ্ন, নাম কি? বাবু। বাড়ি কই? রাজশাহী। ঢাকায় কই থাক? ঢাকায় আইলাম, চাচার বাসায় যামু। কখন আইছ? কতক্ষণ আগে। গাবতলী আইছি। তোমার চাচারে আগে জানাও নাই? জানাইছি, কিন্তু চাচা আইতে না করছিল। বেড়াইতে আইছ? না, কাম শিখবার আইছি। কি কাম? কাঠের কাম। লেখাপড়া না কইরা কাম শিখতে আইছ কেন? বাপে মায়েরে ছাইড়া দিছে, মায়ে কইলো লেখাপড়া কইরা কি হইবো, যা কাম কর। তোমার চাচা কই থাকে? এইখানে লেখা আছে। মোবাইল আছে। বলে একটি কাগজ বের করে দিল। আমি বললাম, আমার কাছে মোবাইল আছে, তোমার চাচারে একটা মোবাইল করি। সে আইসা তোমারে নিয়া যাক। আপনের মোবাইল তন করলে, কত ট্যাকা দিওন লাগবো? টাকা দিওন লাগবো না। এমনিতেই মোবাইল কর।
আমার বন্ধু কাগজটা নিয়ে, আব্দুল্লাহপুরে আলম নামের একজনকে ফোন করল। আলম বলে, ভাই এত রাতে ফোন করছেন? আপনার কাছে একটা ছেলে আইছে, রাজশাহী থেকে, বাবু নাম। ও কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে আছে। আপনি নিয়া যান। হারামজাদারে আইতে না করছি তাও আইছে? যেইখান থেইকা আইছে সেইখানে পাঠাইয়া দেন। সেইখানে তো পাঠানি সম্ভব না। আপনার কাছে আইছে, আপনার নাকি কাঠের কাজ শিখানির কথা, আপনি আইসা নিয়া যান। বাচ্চা পোলা একলা একলা বইসা আছে। ভাই আমি আইতে পারুম না। আপনার এত দরদ, আপনি অরে বাড়িত পাঠাইয়া দেন।
তোমারে তো নিতে আইতে চায় না, কয় বাড়ি পাঠাইয়া দিতে? বাড়ি যাওয়া যাব না। ট্যাকা নাই। আমার বন্ধু বলল, আমি তোমারে বাসে তুইলা দিমু। বাড়ি যাওগা। না, বাড়ি যাওন যাইবো না, বাড়িত গেলে খামু কি? তাইলে কি করবা? এইখানে বইসা থাকমু। কাইল সকালে হের কাছে যামু। হে তোমার কেমন চাচা হয়। আমার বাপের লগে কাম করত। তাইলে তোমারে নিতে চায় না কেন? জানিনা। বন্ধুকে বললাম আরেকবার ফোন করতে। আমার বন্ধু আবার ফোন করলো। ভাই, এইছেলে তো যাইতো চায় না, বলে, আপনার কাছে যাবো, বাড়ি যাব না। আপনে ওরে পাঠাইয়া দেন, না পাঠাইতে চাইলে আপনার কামে যান। আমারে ফোন কইরেন না। ভাই একটা ছোট ছেলে আপনার কাছে আইছে, এখন সারারাত বইসা থাকবো নাকি? সেইটার আমি কি জানি। বলে ফোন কেটে দিল। এই ছেলে তোমারে তো নিতে চায় না। যাও, বাড়ি যাওগা, আমরা টিকিটের ব্যবস্থা কইরা দেই। না বাড়ি যাওন যাইবো না। তাইলে কই যাবা? হের কাছেই যামু, গেলে কিছু কইবো না। তাইলে বাসে কইরা যাওগা, বাস দেখাইয়া দেই। আমার কাছে ১০ ট্যাকা আছে। আমারে আইসা নিয়া যাব। এই ট্যাকা দিয়া মোবাইল করমু।
রাত বারোটার উপরে বেজে গেছে। আমাদের বাসের সময় হয়ে এলো বলে। আমি বন্ধুকে বললাম, চল কিছু টাকা দিয়া এইটারে ওইদিকের কোন বাসে তুলে দেই। আমার বন্ধুও সায় দিল। এই পোলা, তোমারে তোমার চাচার বাসার ওইদিকের বাসে তুইলা দেই। তাকে কিভাবে যেতে হবে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে একটা বাসে তুলে দিলাম। সাথে আরো ৫০ টা টাকা দিয়ে দিলাম। বাসের হেল্পারকে বলে দিলাম যে একে কোথায় নামিয়ে দিতে হবে। তারপর আবার আলমকে ফোন। ভাই বাসে তুইলা দিছি। গিয়া এইখানে থাকবো। আপনি কতক্ষণ পরে আইসা নিয়া যান। ভাই একবার না কইলাম নিতে পারুম না, আবার বাসে তুইলা দিলেন কেন?
সিলেটে যাবার পথে উজান-ভাটি রেস্টুরেন্টে বাস থামে। বাস থেকে নেমে, আবার ফোন করার চেষ্টা, আলমকে। ফোন বন্ধ। পরের দিনও অনেক চেষ্টা করেছি। সেই ফোন আর খোলা পাইনি। তারপর অনেক দিন পর সেই ছেলের কথা আর মনে ছিল না। আজ মনে পড়ল। এই ছেলের কি হয়েছিল জানতে পারিনি। আলমের ফোন নাম্বার হারিয়েও ফেলেছি। হয়তবা এরাই হবে রাস্তার ছেলে, এর দোকান ওর দোকান থেকে চুরি করবে, ধরা পড়বে, মার খাবে। হয়তো বা আরো খারাপ কোন কিছূ। আমরা এদেরকে দেখব, করুণার চোখে তাকাবো, অবহেলা করব।
এখন ভাবি, সেদিন কি কোন ভুল করেছি। এ ছাড়া কি অন্য কিছু করা যেত? আমার বন্ধু আসতে দেরি করায় এত টেনশন করেছি, আমার ছোটভাই সময়মত বাসায় না ফিরলে টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ফোনের পর ফোন করতে থাকি ওর নাম্বারে। এই হলাম আমি, আমাদের অংশ, একখন্ড আমরা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আব্দুল্লাহপুরের সেই লোকটার নাম আলম ছিল কিনা ঠিক মনে নেই। আ জাতীয় অন্য একটা নাম হতে পারে।
শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
কোন মন্তব্য নেই :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন