শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০১০

পথ...

মফস্বল শহরের রিকশাওয়ালাদের কাছে বাস কিংবা ট্রেনের যাত্রীরা হলো গিনিপিগ। তারা জানে, এরা দূর থেকে জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে আসে, তখন কোনরকমে বাড়ি যেতে পারলেই এরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, বিশেষকরে রাতের বেলা যেসব ট্রেন বা বাস এসে পৌছায়। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুন বা তিনগুন ভাড়া চাইতেও এরা কার্পণ্য করে না।

আমি তখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কোন এক ছুটিতে বাড়ী যাব। ট্রেন থেকে নেমে রিকশা নেব। ১০ টাকার ভাড়া আমার কাছে ২৫-৩০ টাকা চাচ্ছে। কিছুক্ষণ দরকষাকষি করে আমি ক্লান্ত। মনে মনে ঠিক করলাম, এরপর ভাড়া ঠিক না করে উঠে পড়ব। যা হবার হবে।

"এই রিক্সা যাবে?" আমার এই প্রশ্নের জবাবে এক রিক্সাওয়ালা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আমি আর কোন কিছু জিঙ্গাসা না করে রিক্সায় উঠে পড়লাম। "নয়াপাড়া চল।" রিক্সাওয়ালা কোন কথা না বাড়িয়ে যাওয়া শুরু করল। রেলস্টেশন থেকে আমার বাসার যাবার জন্য শর্টকাট একটা রাস্তা আছে। রিক্সা ওই পথে না গিয়ে ঘুরপথে যাওয়া শুরু করতেই আমি বললাম, "ঘুরে যাইতেছ কেন? শর্টকাটে যাও।" "ওইদিকের রাস্তা ভাঙ্গা।" - রিক্সাওয়ালার জবাব। আমি বললাম, "ও আচ্ছা, ঠিক আছে।"

আপনে কি করেন? রিক্সাওয়ালার হঠাৎ প্রশ্নে আমি চকিত। আমি বললাম, পড়ালেখা করি। কই পড়েন? সিলেট। ও আচ্ছা, ভার্সিটিতে? আমি বললাম, হু। তুমি সিলেট গেছ কোন সময়? রিক্সাওয়ালার জবাব, না। ততক্ষনে, আমি আমার বাসার কাছাকাছি এসে পড়েছি। সামনে মোড়। আমাদের পাড়ার এলাকা শুরু। আমি কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা বামে মোড় নিল। আমি একটু অবাক হলাম, তবে কিছু বললাম না। একটু পরে আবার আমি কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা হাত দিয়ে সিগনাল দিয়ে হাঁক দিল, বামে থামবো...। রিক্সা ঠিকঠাক আমার বাসার গেট এর সামনে এসে দাঁড়ালো। এস.এস.সি পাশ করার পর থেকে আমি এখানে থাকি না। কোন রিক্সাওয়ালা আমার বাসা চিনতে পারে সেটা আমার কল্পনাতেও আসার কথা না। আমি রিক্সা থেকে নেমে অবাক হয়ে জিঙ্গাসা করলাম, তুমি আমার বাসা চেন? রিক্সাওয়ালা ঘাড় নেড়ে বলল, আপনে মনে হয় আমারে চিনতে পারেন নাই। আমি শীশ। আপনের সংগে ইস্কুলে পড়তাম। এইটুকু শোনার পর, আমার সারা শরীর যেন স্তব্দ্ধ হয়ে গেল। কিছুদূরে ল্যাম্পপোস্ট, আলো-আধারির মধ্যে আমি তখন তাকে চিনতে পারলাম, আমার স্কুল-জীবনের এক সহপাঠির মুখ। তার সাথে আমার কেটেছে অনেকটা সময়, খেলাধুলা অথবা পড়ালেখায়। সে কোন সময়ই ক্লাসের সেরা কয়েকজনের মধ্যে ছিলনা, আবার একেবারে শেষের সারিরও ছিল না। তুই রিক্সা চালাস কেন? পড়ালেখা করিস নাই? সে মাথা নিচু করে আছে। না, আব্বা মরার পর আর লেখাপড়া করি নাই। মায়ে আছে, ছোট ভাই-বোনরা আছে না? আমার দেখাশুনা করা লাগে।

আমার মনে পড়ে গেল কতবার ওদের বাসায় যেতাম। খেলার সময়, অথবা স্কুল ফাকি দিয়ে নদীতে নৌকায় ঘুরতে যাওয়ার আগে স্কুলব্যাগ ওদের বাড়ীতে রেখে যেতাম। কোনদিনও ওর আব্বার সাথে দেখা হয় নাই। আমিও কখনও জিঙ্গাসা করার প্রয়োজন মনে করিনি। সেও আমার বাসায় মাঝে মাঝে আসতো খেলার মাঠে যাওয়ার আগে। একের পর এক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে, স্ফটিক স্বচ্ছ্ব সবকিছুই।

রাত বাড়ছে, আমার বাসায় ঢুকতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা হয়ত টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। আমি মানিব্যাগ থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করলাম। ওর হাতে দিলাম। সে টাকা ফেরত দেবার আগেই আমি বললাম, তুই রেখে দে, আমার কাছে ভাংতি নাই। সে বলে, ভাড়া তো ১০ টাকা। সে আমার দিকে ৯০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, টাকা রাখ, টাকা লাগবে না, তরে অনেকদিন পরে দেখলাম, ভালো লাগলো। পারলে আমার বাসায় আসিস। ঘুইরা যাইস। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে রোবোটের মত টাকাগুলো নিলাম। ও বলল, ভালো থাকিস, ভালো ভাবে পড়ালেখা করিস, অনেক বড় হবি। রিক্সা নিয়ে সে চলে গেল। কিছুক্ষণ হতবাক দাড়িয়ে থেকে আমি কলিং বেল টিপলাম।

সারাদিনের লম্বা জার্নিও সেদিন আমার চোখে ঘুম আনতে পারেনি। দু জন শিশু একই রকম স্বপ্ন নিয়ে পড়ালেখা করতে যায়, দু জন কিশোর একই স্বপ্ন বুকে আকড়ে দিন কাটায়। বড় হবে, অনেক বড়। তাদের মধ্যে একজন শীশ এমন অকালেই ঝরে পড়ে! আমাদের স্পন্দন দারিদ্রতার কষাঘাতে এমনভাবে থেমে যায়!!!

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন